Monday, November 28, 2011

ভালবাসাই আসমা'র মুক্তির পথ


পিচ্চি একটা মেয়ে এসে বলে গেল, “আফনেরে মাসি ডাকে। বিরক্তিতে মনটা ভরে গেল আসমা বেগমের। এই ঘরের মাসিটা এতো খাচ্চর! একশ বার তাকে বলা হয়েছে যে এখন আসমা কোন কাস্টমার নিতে পারবে না তবুও ডাকে। এতো টাকার খাই বুড়িটার!


আসমা বেগম, বয়স একুশ খারাপ পাড়ার বাসিন্দা। ভদ্রলোকরা যাকে বলে পতিতালয়। পতিতালয়- যেখানে পতিতারা থাকে। আসমা বেগম সমাজের চোখে পতিতা। শব্দটা মনে মনে একবার উচ্চারণ করে আসমা। যাদের কারণে সে আজ এখানে, তাদের তো কেউ পতিত বলে না। ষোল বছর বয়সে এখানে প্রথম আসে আসমা। প্রথম প্রথম কাঁদলেও এখন আর কাঁদে না সে। এই জীবনকে মেনে নিয়েছে। প্রতিদিন কিছু শরীরলোভী মানুষ আসবে তার কাছে। নিতান্তই ভালোবাসাহীন কিছু দৈহিক সম্ভোগের পর কটা টাকা ফেলে তারা চলে যাবে- এটাকেই নিয়ম ভেবে দিন কাটাচ্ছিল আসমা।


নিয়মের হেরফের হয় মাস তিনেক আগে। আজকের মত সেদিনও মাসি ডেকেছিল। কোনরকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আসমা যায়। দেখে মাসির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা চেহারার একটা ছেলে। বুড়িটা বলে, “যাও এরে ঘরে নিয়া যাও। ভালো কইরা যত্ন কইরো আসমা তাকায় ছেলেটার দিকে। সাদামাটা কম বয়সী একটা ছেলে। বয়স আর কত হবে, এই ২৫/২৬। অনেকেই আসে। আসমা আসেনবলে ঘরের দিকে আসা শুরু করে। পেছন পেছন সঙ্কুচিতভাবে ছেলেটা এসেছিল। ঘরে এসে আসমা ঘুরে দাঁড়ায়। ছেলেটা জবুথুবু হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। বোঝাই যায় এই প্রথমবার এপাড়ায় আসা। আসমা তার চিরাচরিত ভাষায় বলেছিল, “কি গো নাগর! ভয় পাইতাসো কেন? ভয়ের কিসু নাই। আসো কাসে আসো!ছেলেটা কয়েক পা এগিয়ে বিছানায় এসে বসে।
-        কি করবা নাগর? বুক দেখবা? ব্লাউজ খুলবো?

Monday, November 21, 2011

ভালবাসা আমাদেরকে কতখানি দেয়, আর কতখানি নিয়ে নেয়?


আমি আর তামান্না একই সাথে একটি Public University  থেকে  Under Graduation complete করেছি। আর আমরা প্রিয় শহর ঢাকায় একটি আবাসিক এলাকায় একই ছাদের নিচে বড় হয়েছি।আমরা এক জন আরেকজনকে খুব ভাল করে বুঝতে পারতাম। ওই আমার সবচেয়ে ভাল বান্ধুবী।তাই আমরা কেউ কারো কাছে কিছু গোপন রাখতাম না। honors pass করার পর তামান্নার বিয়ের আলোচনা করছিলো ওর বাবা-মা। ৩/১১/২০১০ ইং তারিখে ওকে বর পক্ষ দেখতে আসার কথা। ২৯/১০/২০১০ ইং তারিখে তামান্না ভীষণ অসুস্থ্য  ( জ্বর প্রায় ১০২ ডিগ্রী সে. ) তাই বর পক্ষ্য আসার তারিখ পেছানো হলো। দুইদিন পর সুস্থ্য হলো। যেদিন ও সুস্থ্য হলো ওই দিন জমিয়ে গল্প করলাম। আর গল্পের বিষয় হলো ওর বিয়েকে নিয়ে।
পরদিন সকালে ৮ টার পর ঘুম থাকে ওঠেই তাড়াহুড়া করে ILTS Center এ চলে গেলাম। যখন দুপুর ১১ টা তখন তামান্নার আম্মু আমাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করে-" তামান্নার সাথে কি তোমার দেখা হয়েছে।" আমি বললাম- না। উনি আর কথা বললেন না। আমি বাড়ি এসেই তামান্নার রুমে প্রবেশ করি, কিন্তু সে নাই। আন্টির কাছে জানতে চাইলে বলেন- "তামান্ন নানুর বাড়ি গেছে।" কবে আসবে? আন্টি জানালেন- আসবে  কিন্তু কবে সেটা ফিক্সড না। আমি বললাম- তামান্নাকে না দেখতে আসার কথা। উনি বলল-বিয়ে এখন দিবে না।আমি অনেকটা অবাক হলাম।
প্রায় দুই সপ্তাহে গড়ালো, তামান্না এখনো নানুর বাড়ি থেকে আসেনি। প্রতিদিনের মতো   ১২/১১/২০১০ ইং ILTS করে বাড়ি আসলাম। বাসাতে ঢুকতেই আম্মু বলল-“তামান্না এসেছে”। আমি দৌড়ে তামান্নার রুমে গেলাম। ও অনেক শুকিয়ে গেছে আর কালো হয়ে গেছে। আমি অকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমি বললাম- তুই আমাকে না বলে চলে গেলি কেন? তামান্না নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। আর কিছুই বলল না। পরদিন সকালে খুব ভোরে তামান্না আমার রুমে এসে হাজির। মনে হল কিছু বলবে। আমি হাত মুখ ধুয়ে এলাম। তারপর দুই জনে ছাদের উপর গেলাম। তামান্না আমাকে হটাSorry বলল। আর বলল-“ তোকে আরো আগেই বলা উচিত ছিল। আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করতাম। তার নাম রায়হান সে M.S.C. করছিল। পরিচয় ২ বছর আগে থেকে ক্যাম্পাসে এক নবান্ন অনুস্ঠানে। সে অনুস্ঠানে উপস্থাপক ছিল। আমি সেই অনুস্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে তার সাথে কথা হয় আর ধীরে ধীরে একজন আরেক জনকে পছন্দ করতে লাগলাম। হঠাসে একদিন আমাকে বলে ফেলে - সে আমাকে ভালবাসে। আরকি আমিও পরদিন আমার মতামত জানিয়ে দিলাম। এরপর থেকে আমি ওর সাথে ক্যাম্পাসে কথা বলতাম না। শুধু ফোনে কথা বলতাম। সে কুমিল্লায় থাকে। আমার যখন বিয়ের কথা চলছিল, সে তখন কুমিল্লায়। আমি তাকে আমার বিয়ের কথা বলি, সে কিছুই বলল না। আমি তাকে ঢাকা আসতে বললে সে বলল এখন আসতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়,তার বাবা নাকি অসুস্থ্য, ওর মা একা একা তার বাবাকে ডক্টরের কাছে নিতে পারেননা। আমি ভেবে ভেবে সারা রাত কান্না করেছি। রায়হানকে অনেকবার ফোন দিয়েছি, কিন্তু সে রিসিভ করেনি।এতো কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু কাউকে বলতে পারলামনা। পরদিন প্রচন্ড জ্বর। সেদিন রাতে সে আমাকে ফোন দিল। বলল ভোরে সে ঢাকায় রওনা দিবে। আর বলল-“তামান্না তুমি বিয়েটা যেকোন ভাবেই হোকনা কেন বন্ধ রাখো। তুমি অন্য কেউকে বিয়ে করলে আমি তোমাকে,ওই ছেলেকে তারপর নিজেকে হত্যা করবো। আমি তোমাকে অন্য কারো অধিকারে মানতে পারবো না।’’ আমি চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। বললাম-“ আব্বুর কলিকের ছেলের সাথে তাই বিয়েটা-তাই আটকানো যাবে না। আর আম্মু আব্বুকে বলে ছিল আমার মতামত জানতে, কিন্তু আব্বু বলল যে আমার উপর উনার বিশ্বাস আছে। তাই আমার আর তোমার সম্পরকের বেপারটা বলে আব্ব কষ্ট পাবেন।’’ তখন রায়হান আর কথা বলল না, ফোনটা রেখে দিল। পরদিন জ্বর কিছুটা কমতে লাগলো। বেলা ১১ টায় রায়হান ঢাকায় এসেই আমাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলে। কিন্তু আমি পারবনা বলে জানিয়ে দিলাম। ও আমাকে অনেক বকা দিতে শুরু করল। আমি বুঝলাম সে খুব রেগে আছে। সে তখন আমার বাড়ির পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো না। তারপর রাতেও অনেকবার ফোনে কথা হল। পরদিন সকালে আমি তোকে সব ঘটনা বলার জন্য তোর ঘরে আসি, কিন্তু শুনলাম তুই ILTS center এ চলে গেছিস। আমি আমার রুমে এসে রায়হানকে ফোন করে জিয়া উদ্যানে দেখা করতে বললাম। রায়হান দেখা করার কথাটা শুনেই ফোনটা রেখা দিল। ২০ মিনিট পর সে বলল- “তুমি কই। আসতেছো না কেন?” আমিতো কিছু বলতেও পারলাম না্‌, ও ফোনটা রেখে দিল। রায়হান আমার সাথে কখোনো মিথ্যা বলেনি। আমি আম্মুকে বললাম- “ আম্মু জাফরিন ২০০০ টাকা নিয়ে যেতে বলেছে।’’ আম্মু আলমারির চাবিটা দিয়ে ডয়ার থেকে টাকা নিতে বলল। আমি ডয়ার খুলে দেখলাম লাখ দশেক টাকা আছে। আমি ৫ লাখ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। সকাল ১০টায় আমি জিয়া উদ্যানে পৌছলাম। তারপর ওর সাথে দেখা হলো। রায়হান আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো, তার চোখ দু’টি দিয়ে জল টলমল করে ঝরতে লাগলো। আমি বললাম "কাঁদছো কেন? আমিতো দেখা করলামি।" সে বলল- “ আরতো তুমি আসবা না।” আমি বললাম- “ আসবো কেন? আমিতো আর যাবো না।’’ সে’তো বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমি বললাম- আমি আর বাড়ি যাবো না, হয়তো তুমি তোমার সাথে নিবা নয়তো আমি এখানে দাড়িয়ে থাকব। রায়হান আমার হাত ধরল,যেনো একটু শক্ত করেই ধরল। তারপর একটা C.N.G. ভাড়া করে ওর মেসে এসে কিছু টাকা নিল। আবার বেরিয়ে পরল। যেতে যেতে বলল এখনি বিয়ে করবে। আমি বললাম- আগে একটা বাসা ঠিক কর। সে বলল ভারা কীভাবে দিব? তখন আমি আমার সব টাকা ওকে দিয়ে বললাম এবার চেষ্টা কর। ও টাকাগুলো নিল। হটা আম্মু প্রায় ১২ টায় ফোন করে বলল-তুমি কোথায়? আমি আম্মুকে বললাম- “আম্মু আমি জাফরিনের কাছে যাইনি। আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বিয়ে করে ফেলেছি।” আম্মু ভীষণ কান্না করছিল। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বাবার বকাঝকা শুনতে পাচ্ছিলাম। ফোনটা কেটে গেল। আমি আমার সিম পরিবর্তন করে ফেললাম। বিকাল ৫ টার দিকে একটা বাসা ঠিক করে নিলাম। তারপর আর কি, দুইজন একই ছাদের নিচে রাতটা জেগেই কাটালাম। পরদিন কুমিল্লা থেকে ফোন আসলে রায়হান কুমিল্লা চলে আসে। আমি রায়হানকে আসতে বারণ করছিলাম, কিন্তুসে শুনেনি। আমি এদিকে একা বাসায়। ফোনে বলল ওর বাবা হাসপাতালে, স্ট্রোক করেছে। ৪ দিন পরের কথা। ও বলল এখন বাবা সুস্থ্য। ৪/১১/২০১০ সে ঢাকা আসে। তারিখটা মনে আছে, কারন ৩ তারিখ ওর জন্ম দিন ছিল। ৫ তারিখে আমরা মার্কেট করলাম। পরের দিনি কোর্ট মেরেজ করবো। রাতে রায়হানকে অস্থির দেখাচ্ছিল।সে কিছু বলল না। বেশ কয়েকবার জানতে চাইলে- সে চেচামেচি করে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেই রায়হানকে বাসায় দেখতে পেলাম না। ভেবেছিলাম নাস্তা কিনে আনতে গেছে। সকাল ৯ টা। ও বাসায় তখনো আসেনি। আমি ফোন করলাম। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করলনা। কিছুক্ষন পর  SMS এ আমাকে বিকেল ৫ টায় প্রস্তুত থাকতে বলল আর ফোন করতে মানা করল।সম্ভবত দপুর ২টা, আমি ফোন করলাম।রিসিভ করল না। আবারও করে SMS লিখল- “বিয়ে করার পর কথা বলব।’’ আমি একটি ভয়স SMS পাঠালাম।ও আবার SMS দিয়ে বলল-“ তোমার কান্না শুনতে আমার ভাল লাগতেসে-কারন ইচ্ছা করতেছে তোমাকে আরো বেশি ভালবাসতে,কিন্ত কি করে বাসি বল- বিয়ের পরেই বাসব, দেখো- তুমি আবার বেশি ভালোবাসার লোভে কানের নিচে হাউমাউ করে কাদবা না। আমি আসতেছি।আর ২ টি ঘন্টা।” ঘড়ির দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম, সময় যেন থেমে আছে ঠিক আমার মত রায়হানের প্রতিক্ষায়। ঠিক ৩ টা বেজে ৪০ মিনিট। সে এখনো আসেনি।  আমি কাপড়চোপড় পড়ে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। ৪ টা বেজে ২০। ওর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, সে ঠিকি ৫ টার আগে এসে পৌছবেই। ৪ টা ৪৫ ।ও তখনো আসেনি। ভাবনা হচ্ছিল। কোথায় আছে তাও জানায় নি। মনে মনে ভাবলাম- কুমিল্লা গেলনা তো। নাকি অন্য কিছু..... সে আমাকে......। সন্ধ্যা হলো সে আসলো না। রাত গেলো। একে একে ৫ টি দিন অতিবাহিত হল। তার কোন খোঁজ পেলাম না। ১২ তারিখ সকাল ১০ টা। তখন আর বুঝতে বাকি নেই- রায়হান আমাকে প্রতারিত করেছে। আমি তখন ভাবতে পারলাম না- কি করব। কি করে আবার আব্বু-আম্মুর কাছে যাই? ইচ্ছে হচ্ছিল- মরে যাই। কিছুক্ষন পরে বাড়িওয়ালার বউ রুমে প্রবেশ করল। উনি রায়হানের কথা জানতে চাইল। আমি কিছু বলছিলাম না।উনি প্রায় আমার থেকে ৪/৫ বছরের বড় হবে। তাই আমাকে বলল- “তুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পার।” আমি পারছিলাম না এত যন্ত্রনা চেপে রাখতে। উনাকে বললাম। উনি আমাকে অনেক বুঝিয়ে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে এবং আব্বু আম্মুকে সব ঘটনা খুলে বলল। তারপর চলে গেলেন। আব্বু-আম্মু আমাকে কিছু বলল না- শুধু বলল –“ আমাদের বলা উচিত ছিল।’’ আমার কিছু বলার ছিল না। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। আব্বকে আমি ভীষণ কষ্ট দিয়েছি।জাফরিন তুই আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোর কাছে ব্যাপারটা গোপন করে ঠিক করিনি।
তামান্নার ঘটনা শুনে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল- রায়হানকে মেরে ফেলতে তারপর  তামান্নাকে অনেক সান্তনা দেই। দিন যেতে থাকে এক এক করে। মনে হচ্ছিল তামান্না রায়হানের কথা ভুলার চেষ্টা করছে। আবার ওর বিয়ের কথা চলছে। এবার একটু তাড়াতাড়িই হলো। হঠাকরে বর পক্ষ দেখতে এল। বর পি.এইচ.ডি করেছে জার্মাণ থেকে নাম ড. হাবিবুর রহমান। তামান্না তার অতীতের কথা উনাকে বুঝিয়ে বলল। হাবিব ভাই সব শুনে কষ্ট পেয়েছেন তা উনার কথা শুনে বুঝা যাচ্ছিল। তামান্না ভীষণ সুন্দরী, আর হাবিব ভাই তা অকাতরে স্বীকার করলেন। আর তিনি খুব চেনা সুরে বললেন-“ চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে।” উনি এতো কিছু জানার পরও বিয়েতে রাজি হলেন।
তামান্না বেশ খুশি খুশি দাখাচ্ছিল। বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হল ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। বিয়ের পর দুই জনই জার্মাণ চলে যাবে। দিনগুলো বেশ ব্যস্ততায় কাটছিলো। একদিন তামান্না বলল-“আমি রায়হানকে বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত দিব। তুইও কিন্তু আমার সাথে যাবি।” আমি সাফ যেতে মানা করলাম। সে কিছুতেই আমার কথা শুনল না। আমাকে বলল বাড়িতে ম্যানেজ করার জন্য। আমি আর কি করি। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে দুজনে বের হলাম বান্ধুবীদের দাওয়াত দাওয়ার জন্য। তামান্না রায়হানের বাড়ি ঠিকানা জানতো। সে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হল আর আমাকে বলল অন্যদের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। প্রায় ১১ টার দিকে  ফোন করে বলল সে ঠিক মতো এসে বাড়িতে পৌছেছে। আর বলল-“ জাফরিন, রায়হানকে বাড়িতে দেখছি না। একটা আধা পাকা বাড়ি। বাড়ির সব জিনিসপত্র ধুলোতে আচ্ছন্ন।রায়হানের আম্মু আসতেছে, তোকে পরে ফোন দিব।”
ঘন্টাখানেক হয়ে গেল একটা মিস কলও দিলনা তামান্না। আমিই ফোন করলাম। একবার না অনেকবার চেষ্টা করলাম কিন্তু সংযোগ পাচ্ছিলাম না। কেন জানি মনে হল- তামান্না আবার রায়হানের মিথ্যা মায়ায় পড়েছে ইবং আবার একই ভুল করেছে। আমি দ্রুত আংক্যাল আন্টিকে এ ব্যাপারটা জানালাম। উনারা আমাকে খুব বকা দিল- আমি ওর সংগ দেওয়াতে। আমি তামান্না থেকে কুমিল্লার ঠিকানাটা শুনেছিলাম আর তা শ্পষ্ট মনে আছে। দেরি না করে আমরা সবাই কুমিল্লায় রওনা দিলাম। ৪টার দিকে রায়হান এর বাড়িতে পৌছলাম।
বাড়িতে পৌছে দেখলাম একটি ছোট ঘরে রায়হানের অসুস্থ্য মা। চোখের পাতা কালো হয়ে আছে। মনে হয় শত ব্যথার জল বয়ে বয়ে শুকিয়ে গেছে। মুখ তার মলিন। আমাদেরকে চেনারও চেষ্টা করলেন না। যেন অতিথি আপ্যায়ন করতে ভুলে গেছেন। দরজার চৌকাঠের কাছে দাড়িয়ে বললেন- কী চাই? আমরা বললাম- এ বাড়িতে কি ১১ টার দিকে একটা মেয়ে এসছিল? রায়হানের মা হু হু করে কেঁদে  বললেন- “ হ্যাঁ, একটি মেয়ে এসেছিল রায়হানকে দাওয়াত দিতে।আমি ওকে বললাম, রায়হান-তো বাড়িতে নাই।সে আমাকে দাওয়াতের কার্ডটা হাতে দিয়ে বলল- রায়হানকে দিয়ে দিয়েন। আমি মেয়েটিকে বললাম- রায়হানকে কীভাবে দিব। সেতো আমাকে এতিম করে চলে গেছে। ওর বাবাও পাগলের মতো একদিন একরাত কান্না করে ষ্ট্রোক করে মারা যান। এক মাস হলো আমি এ ঘরটিতে একা। তারপর মেয়েটি কিছু বলল না। ......... চলে গেল।” রায়হানের মা আর বেশি কিছুই বলতে পারলো না। উনার পুরো বুকটা চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল। আমিও কাঁদছিলাম। সান্তনা দেওয়ার মত কারো মুখে কোন ভাষা জানা ছিলো না। আমরা উনার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলাম তামান্নার খুঁজে।
 রাস্তায় লোকেদের কাছে জানলাম- রায়হান ১১ তারিখ ওর অসুস্থ্য বাবাকে দেখতে আসে, ঢাকায় ফিরার সময় ইলেটগঞ্জের নিকটে একটি দূর্ঘটনায় মারা যায়। আমার ভয় হতে লাগলো তামান্নাকে নিয়ে। ও আবার কি করে বসে। পুরো রাত গেলো তামান্নার কোন খোঁজ পেলাম না। পুলিশ, বিজ্ঞপ্তি, আত্মীয়ের বাড়ি কোথাও খোঁজ করার বাকি রইল না। ওর কোন খবর পেলাম না। পরদিন খবরের কাগজে চোখ থমকে দাড়ালঃ ঢাকা-কুমিল্লা মহা সড়কে পৃথক পৃথক ৩টি বাস দূর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত ও আরো ২৪ জন আহত। আমরা সবাই আবার কুমিল্লায়  আসলাম পাগলের মত- কী যেন এক দুঃস্বপ্ন নিয়ে। গৌরিপুর হাস্পাতালে ৯ টি লাশ ২০ জন আহত। জানলাম এখানে সব লাশ নেই। এখানে তামান্নাকে খোঁজে পেলাম না। ছয়টি লাশ ও ৪ জন মুমূর্ষ ইস্টার্ণ মেডিকেল কলেজে। সেখানেও পেলাম না। তারপর জানলাম ১ টি লাশ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে। সবাই ছুটে গেলাম সেখানে। লাশ ঘরে গিয়ে দেখলাম তামান্না শুয়ে আছে। আংক্যাল- আন্টি দাখেই জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলেন। আমার কিছু মনে পড়ছে না- আমি কি তখন কেঁদেছিলাম কিনা। আমার আব্বু লাশ নেওয়ার কাগজ পত্র ঠিক করল। আমি আসার সময় নার্সকে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। নার্স বলল- মেয়েটি ক্যান্টর্ণম্যান্ট বাস স্ট্যান্ড অপেক্ষা করার সময় একটি বাস তাকে ধাক্কা দিলে- স্থানীয়রা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপারতালে নিয়ে আসে। তেমন কোনো মেজর ইঞ্জুরি হয়নি। রাতে ১১ টায় জ্ঞান ফিরে। কিন্তু কথা বলেনি।শুধু নিজে নিজে কি যেন বলছিল আর চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। রাত ১২ টায় বেশ কয়েকবার হাত পা নেড়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। ডক্টর এসে বলল- মারা গেছে। তার হার্টে দুইটা ব্লক ছিল। আর অতিরিক্ত pressure এর কারনে রক্ত ক্ষরণ হয়ে মারা যায়। দুইটা পরিবার থেকে আনন্দ যেন চিরতরে বিদায় নিল।
আমি আজও তামান্নাকে স্বপ্ন দেখি- মাঝে মাঝে সারা রাত কথা বলি। আর তার কথা মনে হলে খুব কান্না পায়। আমার বিয়ে হয়েছে দুই মাস হল। তামান্নার বাবা-মা গ্রামের বাড়ি থাকেন। তামান্নার একটা ছোট ভাই আছে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। আংকেল-আন্টির সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। আর কুমিল্লায় প্রায় যাওয়া হয়, কারন আমার Husband এর বাড়িও কুমিল্লা। এখানে আসলে রায়হানের মার সাথে দেখা করতে আমার কোন ভুল হয় না। উনার করুণ সিক্ত চোখের শূ্ন্য দৃষ্টি আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়-আপনজন হারানোর বেদনা কত নীল হয়। আর সব স্মৃতির স্মীকরণ ভুল করে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি- ভালবাসা আমাদেরকে কতখানি দেয়, আর কতখানি নিয়ে নেয়?